মুমিনের জীবনে অপরিহার্য অংশ ঈমান।
মুমিনের জীবনে অপরিহার্য অংশ ঈমান

وَمَنْ يَكْفُرْ بِالإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
"আর কেউ ঈমান প্রত্যাখ্যান করলে তার কর্ম বিনষ্ট বা নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
আরবী ‘আমন’ শব্দ থেকে ঈমান শব্দটির উৎপত্তি। আম্ন (أمن) অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, আস্থা, বিশ্বস্ততা, হৃদয়ের স্থিতি ইত্যাদি। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ: নিরাপত্তা প্রদান, আস্থা স্থাপন, বিশ্বাস ইত্যাদি। শব্দটির অর্থ সম্পর্কে ৪র্থ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস (৩৯৫হি) বলেন: "হামযা, মীম ও নূন: এই ধাতুটির মূল অর্থ দুটি: প্রথম অর্থ: বিশস্ততা, যা খিয়ানতের বিপরীত এবং দ্বিতীয় অর্থ বিশ্বাস করা বা কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করা। আমরা দেখছি যে, অর্থ দুটি খুবই নিকটবর্তী ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

তিনি উভয় অর্থে ঈমান শব্দের অর্থ আলোচনা করে উল্লেখ করেন যে, প্রথম অর্থে ঈমান অর্থ নিরাপত্তা প্রদান করা বা আমানতদার বলে মনে করা। আর দ্বিতীয় অর্থে ঈমান অর্থ বিশ্বাস করা, বিশ্বস্ততায় আস্থা স্থাপন করা।
বিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস বিশ্বাস অর্থে কুরআন ও হাদীসে সর্বদা ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাস করল’ অর্থে ‘আ-মানা, আমানূ ইত্যাদি ক্রিয়াপদ, ‘বিশ্বাস কর’ অর্থে তু’মিনু, নু’মিনু ইত্যাদি ক্রিয়াপদ, আদেশ অর্থে ‘আ-মিন, আ-মিনূ ইত্যাদি ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বাসী অর্থে মুমিন, মুমিনূন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আর বিশ্বাস অর্থে ‘ঈমান’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে।
ঈমান ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ঈমান ব্যতীত মানুষ তার কোন সৎ আমলের প্রতিদান পরকালে লাভ করতে পারবে না। আবার ঈমানহীন মানুষ জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ হবে চিরকাল। তাই ঈমানকে ইসলামের মূল খুঁটি বললেও অত্যুক্তি হবে না। এ নিবন্ধে ঈমান সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
ঈমানের আভিধানিক অর্থ : ঈমানের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়া, আশঙ্কা মুক্ত করা। এর বিপরীত হচ্ছে ভয়-ভীতি। রাগেব আল-ইছফাহানী বলেন, ঈমানের মূল অর্থ হচ্ছে আত্মার প্রশান্তি এবং ভয়-ভীতি দূর হয়ে যাওয়া। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে।
ঈমানের শারঈ অর্থ : পারিভাষিক অর্থে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট ঈমান হল মূল ও শাখাসহ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও কর্মে বাস্তবায়নের সমন্বিত নাম। প্রথম দু’টি মূল ও শেষেরটি হ’ল শাখা, যেটা না থাকলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না।
ঈমানের শারঈ অর্থে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যখনই সে পাঁচটি বিষয় তার জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখনই সে একজন ঈমানদার ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবে, নচেৎ নয়।
(১) অন্তরের কথা অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস পোষণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,
وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ، لَهُمْ مَا يَشَاءُوْنَ عِنْدَ رَبِّهِمْ ذَلِكَ جَزَاءُ الْمُحْسِنِيْنَ-
‘যারা সত্যসহ উপস্থিত হয়েছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারাই তো মুত্তাক্বী, তারা যা চাইবে সব কিছুই আছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। এটাই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান’ (যুমার ৩৯/৩৩-৩৪)।
তিনি আরো বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا- ‘তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না’ (হুজুরাত ৪৯/১৫)।
মুমিন ব্যক্তির বিশ্বাসে কোন সন্দেহের লেশমাত্র থাকে না। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি যব পরিমাণও ঈমান বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে এবং যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি গম পরিমাণও পুণ্য বিদ্যমান থাকবে, তাকে জাহান্নাম হতে বের করা হবে। আর যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে আর তার অন্তরে একটি অণু পরিমাণও নেকী থাকবে, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে’। হাদীছের অর্থ এই নয় যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়ে বসে থাকবে। বরং অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল দ্বারাই একজন মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়। যা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দ্বারা বুঝা যায়।
(২) মুখে উচ্চারণ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহর মুখে স্বীকৃতি প্রদান করা, উচ্চারণ করে পড়া এবং আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মা‘বূদ নেই ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর রাসূল। আর ছালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হ’তে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করল। অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন হক থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত’। উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াত এবং হাদীছ থেকে সুস্পষ্ট হ’ল যে, ঈমান অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ ও তদনুযায়ী আমল করা। এই তিনটি বস্ত্তর সমন্বয়েই খাঁটি মুমিন হওয়া যাবে, নচেৎ নয়।
(৩) অন্তরের আমল অর্থাৎ নিয়ত করা। কারণ সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাছ থাকা। কারণ ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে। ভালবাসা, আনুগত্য, আশা-ভরসা ইত্যাদি সবই আল্লাহর জন্য হ’তে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُم بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ ‘আর যেসব লোক সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং এর মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে তুমি দূরে ঠেলে দিও না’ (আন‘আম ৬/৫২)। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসাবে নয়, বরং তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায়’ (লাইল ৯৩/১৯-২০)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيْمَاناً وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُوْنَ-
‘নিশ্চয় মুমিনরা এরূপ যে, যখন (তাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সেই আয়াত সমূহ তাদের ঈমানকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উপর নির্ভর করে’ (আনফাল ৮/২)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ ‘এবং যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে- এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে’ (মুমিনূন ২৩/৬০)।
উল্লিখিত আয়াত সমূহ থেকে এবং অন্যান্য আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর উপর ভরসা, ভয়-ভীতি, আশা-আকাংখা, বিনয়-নম্রতা, আল্লাহর দিকে রুজূ হওয়া ইত্যাদি অন্তরের আমল।
(৪) জিহবা বা মুখের মাধ্যমে আমল। কুরআন তেলাওয়াত, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাকবীর, দো‘আ-ইস্তেগফার ইত্যাদি মুখের ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন,
![]() |
إِنَّ الَّذِيْنَ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَنفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً يَرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّن تَبُورَ-
‘যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, ছালাত কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে তাদের এমন ব্যবসায়ের যার ক্ষয় নেই’ (ফাতির ৩৫/২৯)। তিনি আরো বলেন, وَاتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِن كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ ‘তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট তোমার প্রতিপালকের কিতাব আবৃত্তি কর; তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউই নেই’ (কাহফ ১৮/২৭)।
অন্যত্র তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللهَ ذِكْراً كَثِيراً، وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা কর’ (আহযাব ৩৩/৪১-৪২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَاسْتَغْفِرُوا اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ‘তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকট। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, দয়ালু’ (মুয্যাম্মিল ৭৩/২০)।
এসব দলীল এবং অন্যান্য আরো দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুখের মাধ্যমে উচ্চারণ করে বা পড়ে যেসব আমল করা হয় তা সবই মৌখিক ইবাদতের মধ্যে শামিল হবে।
(৫) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। রুকূ-সিজদা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা, মসজিদের দিকে ছালাতের জন্য রওয়ানা হওয়া, হজ্জ আদায় করা, ছিয়াম পালন করা, আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত করার জন্য আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ইত্যাদি যত প্রকার আমল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা করা হয় সবই এর মধ্যে শামিল হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বিনীতভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে (ছালাতে) দন্ডায়মান হও’ (বাক্বারাহ ২/২৩৮)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ، وَجَاهِدُوا فِي اللهِ حَقَّ جِهَادِهِ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা রুকূ কর, সিজদা কর, তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর ও সৎকর্ম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। আর আল্লাহর পথে জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত’ (হজ্জ ২২/৭৭-৭৮)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْناً وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَقِيَاماً-
‘আর রহমানের বান্দা তারাই যারা (আল্লাহর) যমীনে বিনীতভাবে চলাফেরা করে এবং যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম (শান্তি)। আর তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদারত অবস্থায় ও দন্ডায়মান হয়ে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৪)। এ সম্পর্কে কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আরো অনেক দলীল বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম মুহাম্মাদ হুসাইন আল-আজুর্রী বলেন, ঈমান হচ্ছে অন্তরের বিশ্বাস, মুখের স্বীকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করা। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে সে প্রকৃত ঈমানদার। এরপর তিনি বলেন, জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের ও আমাদের উপর রহম করুন! মুসলমানদের আলেমগণ যে কথার উপর অটল আছেন সেটা হ’ল, ঈমানের (অর্থ হচ্ছে) অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আমল করা সকল সৃষ্টির উপর ওয়াজিব। অতঃপর তিনি বলেন, জেনে রেখ, অন্তরের বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না তার সাথে মুখের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তরের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতি পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা আমল করবে। সুতরাং যার মধ্যে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান সেই প্রকৃত ঈমানদার হ’তে পারবে। আর এর উপরেই কুরআন ও হাদীছের দলীল এবং মুসলমান আলেমদের কথা প্রমাণিত রয়েছে।
মোদ্দাকথা আল্লাহর প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাব সমূহের প্রতি, নবী-রাসূলদের প্রতি, পরকালের প্রতি, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনতে হবে।
মুসলমানের জন্য সর্বোত্তম সম্পদ ঈমান। ঈমানহীন কোনো আমলেরই মূল্য নেই।
আল্লাহতাআলা বলেন, সময়ের কসম! নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। শুধু তারা ব্যতিত; যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে। (সুরা আসর, আয়াত ১-২)
ঈমান অর্থ বিশ্বাস। ইসলামি শরীয়তের সকল বিষয়গুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা ও মনে চলা বা কাজে প্রকাশ করার নাম ঈমান।
এক আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা, তার প্রেরিত কিতাবসমূহ, নবী রাসুলগণ, ফেরেশতাগণ, মৃত্যু, কিয়ামত ও আখিরাত এবং তকদীর এর উপর বিশ্বাস করার নাম ঈমান।
ঈমান মূলত ছয়টি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেগুলো হলো: ১) আল্লাহ, ২) ফেরেশতা, ৩) আসমানী কিতাব, ৪) নবী-রাসুল, ৫) শেষ দিবস ও পুনরুত্থান এবং ৬) ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।
ইসলামে প্রবেশের একমাত্র দরজা হলো কালিমায়ে তাইয়েবা (মহা পবিত্র বাক্য)। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। অর্থ: আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই, মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল)। এই কালেম পাঠ করে ঈমান আনতে হবে।
যে ব্যক্তি খাঁটি দিলে কালিমার দুই অংশ তথা তাওহীদ ও রেসালাত স্বীকার করবে এবং কাজেকর্মে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে, এমন খোশনসীব বান্দার জন্য বড় সুসংবাদ! নবীজী ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি খাঁটি মনে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’-এর স্বাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ পাক তার উপর জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৭)
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সর্বোত্তম জিকির। যে জিকিরের বিনিময় শুধুই জান্নাত। এ তাওহিদের কালেমাই ঈমানের সর্বোচ্চ চূড়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কালেমা এ জিকিরের বিনিময় ঘোষণা করেছেন জান্নাত। 'যে ব্যক্তি ইখলাসের সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে; সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।' (ইবনে হিব্বান)
ঈমান আনার অনিবার্য অর্থ, বান্দা নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করবে। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) ছদ্মবেশে এসে বিশ্ব নবী রাসুলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞেস করেন, ঈমান কাকে বলে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ঈমানের হাকিকত বা স্বরূপ হলো, তুমি বদ্ধমূলভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহ তায়ালার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, আসমানি কিতাবগুলোর প্রতি, আল্লাহর নবী-রাসুলদের প্রতি, কেয়ামত দিবসের প্রতি এবং তাকদিরের প্রতি- অর্থাৎ এ কথা বিশ্বাস করা, ভালো-মন্দ সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হয়। (বুখারি, হাদিস: ৫০)
পৃথিবীতে মানুষকে যা কিছু দেওয়া হয় তার মধ্যে সর্বোত্তম জিনিস হলো, ‘আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা। এই ঈমান তাকে সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন করে। আল্লাহ প্রদত্ত এই নিয়ামত পেলে পূর্বে না পাওয়া কোনোকিছুতে তার আসে যায় না। কারণ সে সামগ্রিক কল্যাণ, সুবিশাল সফলতা ও সুমহান পূর্ণতা পেয়ে গেছে। আর এটা আল্লাহর বড় নিয়ামত। আল্লাহ তাআলা এই সম্পর্কে বলেন, এমনভাবেই আমি আমার আদেশে (দ্বীনের এ) রূহ তোমার কাছে অহী করে পাঠিয়েছি; (নতুবা) তুমি তো (আদৌ) জানতেই না ঈমান কী, কিন্তু একে আমি নূরে পরিণত করেছি, যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা (দ্বীনের) পথ দেখাই। (আশ-শূরা, আয়াত ৪২/৫২)
আল্লাহ ঈমানদারদের ঈমানের মাধ্যমেই বড় পরীক্ষা করে থাকেন। আর এই ঈমান কখনো শক্তিশালী হয়, কখনো দুর্বল হয়, কখনো বাড়ে, কখনোবা কমে। আবার কখনো নতুন ও পুরাতনও হয়ে থাকে। অতএব, মুমিনের কর্তব্য হলো যে, সে তার ঈমানের ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকবে এবং ঈমানের প্রতি যত্নবান হবে। সাথে সাথে আনুগত্যের মাধ্যমে ঈমানে নতুনত্ব আনবে এবং অন্যায় কাজ পরিত্যাগ করার মাধ্যমে হ্রাস পাওয়া হতে ঈমানকে রক্ষা করবে। প্রবৃত্তি ও ফেতনা পরিহার করে চলবে। রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ঈমান তোমাদের অভ্যন্তরে পুরাতন হয়, যেমন কাপড় পুরাতন হয়ে থাকে। অতএব, তোমরা (বেশি বেশি) কুরআন তেলাওয়াত করো, এতে তোমাদের অন্তরে ঈমান শানিত হবে।
ভালো কাজ করলে দুনিয়াতেই তাদের ঈমান বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আর মৃত্যুর সময় তারাও প্রশান্তি ও সৌভাগ্য লাভ করেন। এ কারণেই সাহাবায়ে কেরামের জিজ্ঞাসার জবাবে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘তোমরা তোমাদের ঈমানকে নবায়ন কর। সাহাবায়ে কেরাম জানতে চাইলেন, ‘কীভাবে ঈমান নবায়ন করব? হে আল্লাহর রাসুল! তখন তিনি বললেন, বেশি বেশি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’পড়তে থাকা।’
আর ঈমানের সাথে যেন বাতিলের বাতাস প্রবাহিত না হতে পারে, যার ফলে মুমিনের মাঝে ঈমানের শূন্যতা পেয়ে বসে ও তার অন্তর হতে ঈমানের আলো মুছে যায়। আর এই জন্যই আল্লাহ ঈমানের কিছু উপায় বলে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি ও শক্তিশালী হবে এবং ঈমান হতে অন্ধকার ও আবরণ দূরীভূত হবে। অতএব, যখন কোনো বান্দা নিজের সফলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য, তখন তার জন্য ঈমান বৃদ্ধির উপায়গুলো জানা বিশেষ প্রয়োজন এবং তা নিজের প্রিয়তমা অপেক্ষাও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা তা পবিত্রতা ও কল্যাণের উৎস।
Comments
Post a Comment