ঈমান বৃদ্ধি ও কমে যাওয়ার প্রধান কিছু উপায় বা কারণসমূহ।

            

          ঈমান বৃদ্ধি ও কমে যাওয়ার প্রধান কিছু উপায় বা কারণসমূহ।


চিন্তা সহকারে কুরআন তেলাওয়াত করা:-

কুরআন হলো আল্লাহর কালাম, যার মাধ্যমে তাঁর নাম ও গুণাবলি জানা যায় এবং তা হতে শরীআত ও তার বিধি-বিধান উন্মোচিত হয়। যার দিকে অগ্রসর হলে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তা হতে মুখ ফিরিয়ে নিলে ক্ষতি ও পরিতাপের বিষয় হিসাবে পরিণত হয়। আল্লাহ বলেন, আমি এই বরকতময় কিতাব তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে তারা এর আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। (সুরা ছোয়াদ, আয়াত ২৯) এই কিতাবে মুমিনদের জন্য রয়েছে এক বিরাট প্রাপ্তি এবং মুমিনজীবনে রয়েছে এর সম্মানজনক প্রভাব। আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেন, আসল মুমিন তো তারাই যাদের নিকট আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে তাদের অন্তর প্রকম্পিত হয় এবং তাদের নিকট আল্লাহর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হলে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তারা তাদের রবের উপরই ভরসা রাখে। (সুরা আল-আনফাল, আয়াত ২)।

যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব পড়বে এবং তাঁর আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, নিঃসন্দেহে সে অনেক ইলম অর্জন করতে পারবে। আর এর মাধ্যমে তার ঈমান শক্তিশালী হবে ও বৃদ্ধি পাবে।

আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা:-

ঈমান বৃদ্ধির উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম বিষয়টি হলো, আল্লাহ সম্পর্কে ও তাঁর সুন্দরতম নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সম্পর্কে অবগত হওয়া। কেননা এগুলো সম্পর্কে জানলেই মানুষ আল্লাহমুখী হবে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তাআলার জন্যই সুন্দরতম নামসমূহ। অতএব, তোমরা সেসব ভালো নামেই তাঁকে ডাকো। যারা তাঁর নামসমূহের বিকৃতি ঘটায়, তাদের পরিত্যাগ করো। যা কিছু তারা করে তার প্রতিদান তাদের দেওয়া হবে। (সুরা আল-আ‘রাফ, আয়াত ১৮০)

আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন, আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সব উত্তম নাম। কাজেই সে নাম ধরেই তাঁকে ডাক। আর তাদেরকে বর্জন কর, যারা তাঁর নামের ব্যাপারে বাঁকা পথে চলে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে। (সুরা আল-আ’রাফ, আয়াত ১৮০)


দ্বীনের সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা:-

ঈমান বৃদ্ধির উপায়গুলোর মধ্যে হতে আরেকটি উপায় হলো— এই দ্বীনের সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ও এর শরীআতের পরিপূর্ণতার প্রতি অবগত হওয়া এবং আক্বীদা, আখলাক্ব, আদব, ব্যবস্থাপনা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া। কারণ তা শ্রেষ্ঠ বিচারক ও দয়াবান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা শরীআত। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যদি তুমি দ্বীন ইসলাম ও শারীআতে মুহাম্মাদী নিয়ে গবেষণা কর তাহলে দেখতে পাবে কোনো বক্তব্য, বর্ণনা বা জ্ঞানীদের বাণী দ্বারা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদিও এতে জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞজনদের সবার জ্ঞানকে একত্রিত করা হয়। তবুও তারা এ কথা বলতে বাধ্য হবে যে, এটা এক মহান কিতাব, যা অনির্বচনীয়; বরং তা নিজেই সত্যের সাক্ষী এবং তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া হয়। নিজেই তা প্রামাণ্য দলীল ও তার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয় এবং কোনো নবী যদি তার স্বপক্ষে দলীল নিয়ে নাও আসতেন, তথাপি তা যে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসা দলীল ও নিদর্শন তা প্রমাণিত হত। আর এসবকিছু হতে বুঝা যাচ্ছে যে, তার ইলম, হিকমত, রহমত, পুণ্যতা, মহানুভবতা, অদৃশ্য জানা, ইহকাল-পরকাল ইত্যাদির প্রতি। আর তিনিই তাঁর বান্দদের উপর নিয়ামত দান করে থাকেন।


ইহসান অবলম্বন করা:-

ইহসান মানুষের ঈমান বৃদ্ধি করে। নবীজি (সা.)-এর ভাষায় ইবাদতের ক্ষেত্রে ইহসান হলো, আপনি এমন ভাবে আল্লাহর ইবাদত করবেন, যেন আপনি তাঁকে দেখছেন, আর যদি আপনি তাঁকে দেখতে না পান তবে (মনে করবেন) তিনি আপনাকে দেখছেন। (বুখারি, হাদিস : ৫০)

ইহসানের আরেক অর্থ হলো, মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করা। এটিও মানুষের ঈমান বৃদ্ধি করে, আল্লাহর প্রিয় করে। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মাখলুকের প্রতি ইহসান করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমা লঙ্ঘন করতে। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমাদের শিক্ষা গ্রহণ কর।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)



বেশি বেশি সৎ কাজ সম্পাদন করা:-

সৎ আমল যতই বৃদ্ধি পাবে, ঈমান ততই বৃদ্ধি পাবে। এই সৎ আমল মুখের কথার মাধ্যমে হোক, কিংবা কাজের মাধ্যমে হোক যেমন যিকির-আযকার, নামায, রোযা এবং হজ্জ। এসব কিছুই ঈমান বৃদ্ধির মাধ্যম।
যার যত বেশী সৎ আমল রয়েছে, সে ব্যক্তি ঈমানের দিক থেকে তত বেশী শক্তিশালী এবং এর ফলশ্রুতিতে জান্নাতেও তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারাই সত্যিকারের ঈমানদার। এদের জন্যেই রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট উচ্চমর্যাদা। আরও রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। (সুরা আনফাল, আয়াত ৪)।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঈমানদার নর-নারীর গুণাবলি বর্ণনায় প্রথমেই সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করার গুণটি উল্লেখ করেছেন। তাই এ কাজ করা আমাদের ঈমানের দাবি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর ঈমানদার নর-নারী একে অপরের সহায়ক। তারা সৎ কাজে আদেশ করে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। তাদেরই ওপর আল্লাহ তায়ালা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী।’ (সুরা তাওবা, আয়াত ৭১)। এ দায়িত্ব পালনের জন্য মুসলমানদের ভেতর থেকে একটি দলকে প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা সৎ কর্মের প্রতি আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই হলো সফলকাম।’(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৪)
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা একজন আহ্বানকারীকে ঈমানের দিকে আহ্বান করতে শুনেছি (এই বলে) যে, ‘তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন,’ সুতরাং আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করুন, আমাদের পাপসমূহ মোচন করুন এবং আমাদেরকে পুণ্যবানদের সঙ্গে মৃত্যু দান করুন। (সুরা আল ইমরান ৩:১৯৩)
আল্লাহ বলেন, মানুষ কি মনে করে যে, তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে (এজন্যে) যে, তারা বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না। এবং অবশ্যই আমি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম, এবং আল্লাহ্ অবশ্যই জেনে নিবেন (স্পষ্ট করবেন) যারা সত্য বলেছে তাদেরকে এবং তিনি অবশ্যই জেনে নিবেন মিথ্যাবাদীদেরকে। (সুরা ‘আনকাবূত, আয়াত ২-৩)

হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. ইরশাদ করেন, ঈমানের সত্তরটির বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। অন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম হলো এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনও উপাস্য নেই। এর সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা হতে কষ্টদায়ক জিনিস দূরে সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। (সহীহ্ বুখারী: ৯, সহীহ্ মুসলিম:৩৫)

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা নীরবতা অবলম্বন করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন মেহমানদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। (সহীহ্ মুসলিম:৪৭)

হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সা. ইরশাদ করেন, যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকবে সে ওই বৈশিষ্ট্যগুলো কারণে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে। সে বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-


ক. যারা নিকট আল্লাহ্ ও তার রাসূল সা. অন্য সবকিছু হতে সর্বাধিক প্রিয় হবে।
খ. যে ব্যক্তি কোনও বান্দাকে কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালোবাসবে।
গ. যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহে কুফরি হতে মুক্তি লাভের পর পুনরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে এভাবে অপছন্দ করে, যেভাবে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে। (সহীহ্ বুখারী: ২১, সহীহ্ মুসলিম:৪৩)

আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়া:-

ঈমান দৃঢ় করার অন্যতম মাধ্যম হলো, মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা। এতে নিজের মধ্যেও ইবাদতের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে, ঈমান বৃদ্ধি পাবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর পথে আহ্বানকারীদের প্রশংসা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা হা-মিম সাজদা, আয়াত : ৩৩)


ঈমান কমে যাওয়ার কারণসমূহ:-

প্রথম কারণ: আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ঈমান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যতই কমবে, ঈমানও তত কমতে থাকবে।

দ্বিতীয় কারণ: সৃষ্টিতে ও শরীয়তে আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে গবেষণা করা থেকে বিরত থাকা। কেননা আল্লাহর সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনা না করা ঈমানের ঘাটতি হওয়ার অন্যতম কারণ।

তৃতীয় কারণ: গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া। কেননা গুনাহের কাজ করলে অন্তরে এবং ঈমানের উপর বিরাট প্রভাব পড়ে। এই জন্যই নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ব্যভিচারী ঈমান থাকা অবস্থায় ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না।

চতুর্থ কারণ: সৎ আমল না করা ঈমান হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু যদি বিনা কারণে কোন ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে ঈমান কমার সাথে সাথে সে শাস্তির সম্মুখীন হবে। অবশ্য গ্রহণযোগ্য কারণে ওয়াজিব ছেড়ে দিলে অথবা ওয়াজিব নয় এমন কাজ ছেড়ে দিলে ঈমানের ঘাটতি হবে, কিন্তু শাস্তির সম্মুখীন হবে না।
ঈমানের আলোর উপর যারা প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তারা আদম শ্রেষ্ঠতম সন্তান। যাদের মধ্যে ঈমানের মৌলিক দিকগুলো রয়েছে, যা তাদের ঈমানের আলোর উপর পরিচালিত করছে। আর যদি তাদের নিকট জ্ঞানবিরোধী কিছু পেশ করা হয়, তাহলে তাদের চোখে তা ঘোরতর অন্ধকার রাতের মতো মনে হয়।
পরকালের কল্যাণকামী মানুষের জন্য আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমান তথা ইয়াক্বিন হলো বান্দার বিশেষ সম্পদ। যারা এ সম্পদে সমৃদ্ধ হয়, তারাই প্রকৃত মুমিন। তাঁরাই দুনিয়া এবং আখিরাতে কামিয়াবী লাভ করে। কুরআন হাদিসের জান্নাতের সুখবরও তাদের জন্য নির্ধারিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঈমান, ইয়াকিন এবং দ্বীন ইসলামকে বুঝার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দিন।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। (সুরা মুজাদালাহ, আয়াত ১১)


Comments