ইসলামে সঞ্চয়ের গুরুত্ব ও অতিরিক্ত সঞ্চয়ের শাস্তি।
ইসলামে সঞ্চয়ের গুরুত্ব ও অতিরিক্ত সঞ্চয়ের শাস্তি।
وَلَا تَجۡعَلۡ یَدَکَ مَغۡلُوۡلَۃً اِلٰی عُنُقِکَ وَلَا تَبۡسُطۡہَا کُلَّ الۡبَسۡطِ فَتَقۡعُدَ مَلُوۡمًا مَّحۡسُوۡرًا
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন:- ‘তুমি (কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে রেখে একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না। আবার (অপব্যয়ী হয়ে) একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল-১৭, আয়াত : ২৯)।
ٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡاَحۡبَارِ وَالرُّہۡبَانِ لَیَاۡکُلُوۡنَ اَمۡوَالَ النَّاسِ بِالۡبَاطِلِ وَیَصُدُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ وَالَّذِیۡنَ یَکۡنِزُوۡنَ الذَّہَبَ وَالۡفِضَّۃَ وَلَا یُنۡفِقُوۡنَہَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۙ فَبَشِّرۡہُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ
অর্থঃ
হে মুমিনগণ! (ইয়াহুদী) আহবার ও (খ্রিস্টান) রাহিবদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে, যারা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভোগ করে এবং (অন্যদেরকে) আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। ৩২ যারা সোনা-রুপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাময় শাস্তির ‘সুসংবাদ’ দাও। ৩৩
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন- যারা সোনা ও রূপা জমাকরে কিন্তু তা থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণায়ক শাস্তির সংবাদ দিন, (সূরা তাওবা-০৯, আয়াত : ৩৪)।
অর্থ ইচ্ছামত খরচ করা বা অপচয় করা যাবে না। বরং আয়-ব্যয় দু’টিই হালাল পথে ও ইসলামের নির্দেশিত পথে খরচ করতে হবে। কেননা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর দেওয়া প্রতিটি নে‘মত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে (তাকাছুর ৪
ইসলামে অপচয় ও বিলাসিতা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কেননা ভোগ-বিলাস ব্যক্তিকে আরাম-আয়েশ ও কর্মহীনতায় উৎসাহিত করে। পূর্ববর্তী লোকেরা বিলাসিতার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে (আন‘আম ৬/১৪১; আ‘রাফ ৭/৩১; বনু ইস্রাঈল ১৭/১৬, ২৭)। তবে আল্লাহ প্রদত্ত নে‘মতের যথাযথ শুকরিয়া আদায়ের স্বার্থে প্রয়োজনীয় খাতে অবশ্যই ব্যয় করতে হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ তাঁর বান্দার উপরে তাঁর দেওয়া নে‘মতের নমুনা দেখতে ভালবাসেন’ (তিরমিযী হা/২৮১৯; আহমাদ হা/১৯৯৪১; মিশকাত হা/৪৩৫০, ৪৩৭৯)। এজন্য সর্বদা মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। যেমন প্রয়োজনাতিরিক্ত খরচ করা যাবে না, তেমনি কৃপণতাও করা যাবে না (ফুরক্বান ২৫/৬৭)।
ইসলামে সম্পদ খরচের ক্ষেত্রে কৃপণ হওয়া যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি প্রাচুর্যের সময় অপচয় অপব্যয় করে সম্পদ খরচ করাও নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে কারিমে অপচয় ত্যাগের কঠোর নির্দশ জারি করে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আহার এবং পান করো, আর অপচয় করো না; তিনি (আল্লাহ) অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।’’ -সূরা আরাফ: ৩২
অপচয় এবং কৃপণতা দু’টোই ইসলামে অনুনমোদিত। এই দুই প্রান্তিকতার মাঝখানে মধ্যমপন্থা হিসেবে মিতব্যয়ী হয়ে ভবিষ্যতের জন্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করে রাখা ইসলামের শিক্ষা। যারা অপচয় এবং কৃপণতার পথ পরিহার করে মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করবে আল্লাহ তাদেরকে নিজের বান্দা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(রহমানের বান্দা তো তারাই) যারা অপব্যায়ও করে না আবার কৃপণতাও করে না। তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। ’ -সূরা ফুরকান: ৬৭
অর্থোপার্জন, খরচ ও সঞ্চয়ের ব্যাপারে মাধ্যমপন্থার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মনে রাখতে হবে, সঞ্চয় করতে গিয়ে কৃপণের তালিকায় যেন আপনার নাম না উঠে। কৃপণতা ও অপব্যয় সম্পর্কে সমাজের প্রচলিত ধারণাটি ভুল। যাকে বলে গোড়ায় গলদ। অনেকে মনে করেন, জন্মদিন, মৃত্যুদিবস, বিয়েবার্ষিকী ও ভালোবাসা দিবসের মতো বিভিন্ন দিবস কিংবা বার্ষিকীতে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নির্বিচারে ধার-দেনা করে হলেও খরচ করতে পারাই যেন উদারতা। ক্রমবর্ধমান এমন অযাচিত খরচের জোগান ও আনুষ্ঠানিকতায় তাল মেলাতে কালো টাকার পেছনে দৌড়ানো এবং চোরাপথ আবিস্কার করাও যেন দূষণীয় নয়!
পক্ষান্তরে যে হালাল-হারাম, পাপ-পুণ্য, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বিবেচনা করে খরচ করেন এবং অপব্যয়-অপচয় থেকে বিরত থাকেন- তাকে মনে করা হয় ‘কৃপণ’। স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির ভরণপোষণ, পিতামাতার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের মতো আল্লাহ নির্দেশিত খাতে খরচ করতে অবহেলাই হলো- প্রকৃত কৃপণতা। অনেকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচটুকু করতে করে না, অভাবগ্রস্থকে কিছু দান করে না; জরুরী দ্বীনি কাজে অর্থ ব্যয় করে না- তাকেও কৃপণ বলা হয়।
এর বাইরে যে ব্যক্তি এসব খাতে খরচ করতে অকুণ্ঠ কিংবা দ্বিধাবোধ করেন না, তবে বিভিন্ন দিবস-বার্ষিকীর অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ খরচে রাজি নন- সমাজের কিছু লোক তাকে ‘মহাকৃপণ’ বললেও তিনি কিছুতেই কৃপণ নন। বরং তিনি মিতব্যয়ী।
বস্তুত হালাল-হারামের বিধিনিষেধ মেনে খরচকে সীমাবদ্ধ করতে হবে। প্রাচুর্যের সময় খরচের উৎসবে মেতে না উঠে অপ্রয়োজনীয় কিংবা হারাম খরচ বাদ দিয়ে মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করে উদ্ধৃত অর্থ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করতে হবে। যেন পরে নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত পাতার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়।
অপব্যায় না করে সন্তানদের জন্য কিছু সঞ্চয় করাও ইসলামের শিক্ষা। সন্তানদের কারও মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়া নবীজি (সা.) পছন্দ করেননি। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদেরকে সচ্ছল রেখে যাবে- এটাই উত্তম। ’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
ইসলাম সঞ্চয়কে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে তা আরও স্পষ্ট হয় রাসূলে কারিম (সা.)-এর হাদিস থেকে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘উত্তম দান তাই, যা নিজ অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে হয়। ’ –সহিহ বোখারি: ২/১১২
কৃপণ না হয়ে ইসলাম নির্দেশিত খাতে খরচে কোনো রকম দ্বিধা না করে, হারাম পথে খরচের সব পথ বন্ধ করে দিয়ে; অপচয়-অপব্যয় না করার মাধ্যমে মিতব্যয়ী হলে দারিদ্রমুক্ত জীবন আল্লাহ তাকে দান করবেন। এটা রাসূলে কারিম (সা.)-এর ভবিষ্যতবাণী।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলে কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পরিমিত ব্যয় করে সে নিঃস্ব হয় না। ’ -মুসনাদে আহমাদ: ৭/৩০৩
অর্থাৎ যে ব্যক্তি অর্থব্যয়ে পরিমিতবোধের চর্চা করবে, অনটন তার নাগাল পাবে না। ইসলামের এ মহান শিক্ষাটি যথাযথ অনুসরণ না করার কারণে মানুষ উপার্জনের যাচিত সুফল থেকে বঞ্চিত।
কৃপণ না হয়ে মিতব্যয়ী হয়ে সঞ্চয় করলে হাজার কোটি টাকার মালিক হতেও ইসলাম নিষেধ করে না। সঞ্চিত অর্থ থাকলেই তো অর্থনির্ভর আমলগুলো করা যাবে। রোজাদারকে ইফতার করানো যাবে। শরিক হওয়া যাবে জনকল্যাণমূলক নানা কাজে। চালু করা যাবে সদকায়ে জারিয়ার অফুরন্ত ধারা। আবার উদ্ধৃত অর্থ যখন নেসাব পরিমাণ হবে এবং তা বর্ষপূর্তি হবে তখন সেখানে এসে যাবে জাকাতের মতো আরেকটি মহান ইবাদতের সুযোগ।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সুন্দরভাবে জীবন পরিচালনার জন্য অর্থের জোগান দিতে হবে। সে জন্য আল্লাহ তাআলাও রিজিক অনুসন্ধানের জন্য আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
সুরা : জুমুআহ, আয়াত : ১০)
জীবিকা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইসলাম কাউকে লাগামহীন স্বাধীনতা প্রদান করেনি। সম্পদ উপার্জন এবং তার ব্যয় করা বিভিন্ন নীতিমালার ছাঁচে আবদ্ধ করে দিয়েছেন। মানুষ যখন এসব নীতিমালা মেনে জীবনযাপন করবে তখনই মানবজীবনে আসবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ও সচ্ছলতা। আর যদি তা না মেনে যাচ্ছে-তাই করা হয়, তাহলে নানা বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক ধ্বংস নেমে আসবে।
হালাল উপার্জন : উপার্জনের জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে তা বৈধ পন্থায় উপার্জন করা। সুতরাং অবৈধ পন্থায় কোনো ধরনের সম্পদ কামানোর অনুমতি নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা পরস্পর একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না, তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টিক্রমে কোনো ব্যবসায় করা হলে (তা জায়েজ)...।’ (সুরা : আন নিসা , আয়াত : ২৯)
সুতরাং উপার্জনের প্রথম স্তরই হবে বৈধ পন্থা।
চাই তা ব্যবসা, চাকরি, কৃষিকাজ বা অন্য যেকোনো পেশায় হোক না কেন।
পরিবারের জন্য খরচ করা : সম্পদ উপার্জনের পর তার নিজের প্রয়োজন ও পরিবারের সদস্যদের মাঝে ব্যয় করার প্রথম নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খরচা দেবে আর যার জীবিকা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে (অর্থাৎ যে গরিব) সে, আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচা দেবে। আল্লাহ যাকে যতটুকু দিয়েছেন তার বেশি ভার তার ওপর অর্পণ করেন না। আল্লাহ সংকটের পর স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করে দেবেন।
(সুরা : আত-তালাক, আয়াত : ৭)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুলাহ (সা.) বলেছেন, ‘একটি দিনার তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করলে, একটি দিনার গোলাম আজাদ করার জন্য এবং একটি দিনার মিসকিনদের দান করলে এবং আর একটি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করলে। এর মধ্যে (সওয়াবের দিক থেকে) ওই দিনারটিই উত্তম, যা তুমি পরিবারের লোকদের জন্য ব্যয় করলে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২০১)
অপচয় না করা :
খরচ করার ক্ষেত্রে ভারসাম্যনীতিতে চলার জন্য আদেশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বাড়াবাড়ি করে থাকেন। এ জন্য সম্পদ যত বেশিই থাকুক না কেন, কোনোক্রমেই অপচয়, অপব্যয় করা যাবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং যারা ব্যয় করার সময় অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্য করে না; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।’ (সুরা : আল-ফুরকান, আয়াত : ৬৭)
কৃপণতা নিষিদ্ধ :
কৃপণতা একটি মারাত্মক ব্যাধি। ব্যক্তি সমাজ ও পরিবার সবাই এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপচয় ও কৃপণতা কোনোটাই কাম্য নয়; বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করা চাই। কোরআনে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এবং যারা ব্যয় করার সময় অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্য করে না; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান।’ (সুরা : আল-ফোরকান : ৬৭)
আবার অর্থসঞ্চয় করতে গিয়ে কৃপনতাকেও আল্লাহ পছন্দ করেন না। আল্লাহ বলেন, ‘যে অর্থ সঞ্চয় করে ও তা বারবার গুণে দেখে।’ (সুরা হুমাযাহ ২) এ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বান্দার অর্থলিপ্সার কথা বলেছেন। আয়াতে একে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, অর্থ লিপ্সার কারণে সে তা বারবার গণনা করে। অন্যান্য আয়াত ও হাদিস সাক্ষ্য দেয় যে, অর্থ সঞ্চয় করা সর্বাবস্থায় হারাম ও গুনাহ নয়। তাই এখানে উদ্দেশ্য এই সঞ্চয় হবে, যাতে জরুরি হক আদায় করা না হয় কিংবা গর্ব ও অহমিকা লক্ষ্য হয় কিংবা লালসার কারণে দিনের জরুরি কাজ বিঘ্নিত হয়। তখন সে অর্থ সঞ্চয় হারাম বলে বিবেচিত হবে। (মারেফুল কোরআন)
Comments
Post a Comment